করোনাভাইরাস নিয়ে কোনটা ভুল তথ্য, কোনটা সঠিক? জেনে নিন বিস্তারিত

করোনাভাইরাস নিয়ে গোটা বিশ্ব এখন চিন্তিত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে নানা রকম গুজব! কোনটি সঠিক আর কোনটি ভুল, তা যাচাই না করেই অনেকে শেয়ার করছেন। ফলে ভুল ও গুজবের আড়ালে মানুষ সঠিক তথ্য পাচ্ছেন না এবং বিভ্রান্ত হচ্ছেন অনেকেই। কাজেই, যেকোন তথ্য শেয়ার করার আগে যাচাই করুন।

ভয়ের বিষয় হচ্ছে এসব অপরীক্ষিত কৌশল ও পরামর্শ যদি সঠিক না হয়, তবে এ থেকে আরো বেশি বিপদ ঘটতে পারে। এ ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া পরামর্শই আমাদের অনুসরণ করা উচিত। আসুন, দেখে নেই ভাইরাসটি নিয়ে আমাদের চারপাশে কী কী ভুল তথ্য রয়েছে এবং এগুলো সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কী বলছে।

ভুল তথ্য: করোনাভাইরাস গরম তাপমাত্রায় (যেমন বাংলাদেশ) ছড়ায় না, বরং মারা যায়।

সঠিক তথ্য: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, এখন পর্যন্ত উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়াসহ সব ধরনের পরিবেশ এবং এলাকায় করোনাভাইরাসের সংক্রমিত হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। জলবায়ু ও আবহাওয়া যেমনই হোক, সতর্ক থাকুন। কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছে এমন এলাকা ভ্রমণের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সতর্ক থাকুন। মনে রাখবেন, কোভিড-১৯ থেকে সুরক্ষিত থাকার সবচেয়ে ভালো পথ হচ্ছে একটু পরপরই সাবান-পানি বা অ্যালকোহলভিত্তিক হ্যান্ড রাব বা স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করা। একই সঙ্গে হাত দিয়ে নাক, মুখ ও চোখ স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকুন।

ভুল তথ্য: বরফ বা অতিরিক্ত ঠান্ডা তাপমাত্রায় করোনাভাইরাস মারা যায়।

সঠিক তথ্য: বাইরের তাপমাত্রা যাই থাকুক না কেন, সাধারণ মানুষের শরীরের তাপমাত্রা থাকে ৩৬ দশমিক ৫ থেকে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাই, মানুষের শরীরে করোনাভাইরাস থাকলে অতিরিক্ত ঠান্ডা তাপমাত্রায় এ ভাইরাস মরবে না।

ভুল তথ্য: গরম পানিতে গোসল করোনাভাইরাস রোধে কার্যকর।

সঠিক তথ্য: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, গরম পানিতে গোসলের মাধ্যমে করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষিত থাকা যাবে না। কারণ, বাইরের তাপমাত্রা যা-ই হোক না কেন, মানুষের শরীরের তাপমাত্রা ৩৬ দশমিক ৫ থেকে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের থাকে। মনে রাখবেন, কোভিড-১৯ থেকে সুরক্ষিত থাকার সবচেয়ে ভালো পথ হচ্ছে একটু পরপরই সাবান-পানি বা অ্যালকোহলভিত্তিক হ্যান্ড রাব বা স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করা। এর মাধ্যমেই আপনার হাতে থাকা জীবাণু অপসারিত হবে। একই সঙ্গে হাত দিয়ে নাক, মুখ ও চোখ স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকুন।

ভুল তথ্য: মশার মাধ্যমে নতুন করোনাভাইরাস ছড়ায়।

সঠিক তথ্য: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, মশার মাধ্যমে নতুন করোনাভাইরাস ছড়ানোর বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো তথ্য বা প্রমাণ পাওয়া যায়নি। নতুন এই ভাইরাস শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি ভাইরাস। আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি বা কাশির সময় তাদের শ্বাসতন্ত্র থেকে নির্গত ছোট ছোট তরল ফোঁটা বা নাক ঝাড়ার সময় নির্গত তরল ফোঁটার মাধ্যমে ছড়ায়। নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে একটু পরপর হাত পরিষ্কার করুন এবং হাত দিয়ে নাক-চোখ-মুখ স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকুন। একই সঙ্গে হাঁচি-কাশি রয়েছে—এমন ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন।

ভুল তথ্য: হ্যান্ড ড্রায়ার বা হাত শুকানোর মেশিনে হাত শুকালে করোনাভাইরাস মারা যায়।

সঠিক তথ্য: হ্যান্ড ড্রায়ার দিয়ে হাত শুষ্ক করার মাধ্যমে নতুন করোনাভাইরাসকে মারা যায় না। কোভিড-১৯ থেকে সুরক্ষিত থাকার সবচেয়ে ভালো পথ হচ্ছে একটু পরপরই সাবান-পানি বা অ্যালকোহলভিত্তিক হ্যান্ড রাব বা স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করা। হাত ধোয়ার পরপরই টিস্যু পেপার বা উষ্ণ বাতাস বা হ্যান্ড ড্রায়ার দিয়ে হাত শুকিয়ে নিন। একই সঙ্গে হাত দিয়ে নাক-চোখ-মুখ স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকুন।

ভুল তথ্য: আলট্রা-ভায়োলেট বা অতিবেগুনি রশ্মি দিয়ে করোনাভাইরাস মারা যায়।

সঠিক তথ্য: অতিবেগুনি রশ্মি ব্যবহার করা উচিত নয় কারণ এ রশ্মি থেকে ত্বকের বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা থাকে।

ভুল তথ্য: থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিকে শনাক্ত করা যায়।

সঠিক তথ্য: কারও শরীরে জ্বর থাকলে, তা থার্মাল স্ক্যানারে ধরা পড়বে। নতুন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে যেসব লক্ষণ প্রকাশ পায়, তার একটি হলো জ্বর। তবে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জ্বর হয় না। এমন লক্ষণ প্রকাশ পেতে ২ থেকে ১০ দিন পর্যন্ত সময় লাগে। তাই জ্বর নেই, কিন্তু করোনাভাইরাসে আক্রান্ত—এমন ব্যক্তিকে থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে শনাক্ত করা যায় না।

ভুল তথ্য: শরীরে অ্যালকোহল বা ক্লোরিন ব্যবহারে করোনাভাইরাস মারা যাবে।

সঠিক তথ্য: এভাবে করোনা ভাইরাস মরে না। বরং এটা করলে শরীরের ক্ষতি হতে পারে। তবে, ঘরের জিনিসপত্র জীবাণুমুক্ত রাখতে সতর্কতার সঙ্গে এগুলো ঘরের জিনিসপত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে ব্যবহারের আগে অবশ্যই  বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মেনে ব্যবহার করতে হবে।

ভুল তথ্য: নিউমোনিয়ার ভ্যাকসিনে করোনাভাইরাসের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

সঠিক তথ্য: না। নিউমোকক্কাল ভ্যাকসিন বা হিমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ বি ভ্যাকসিনসহ নিউমোনিয়ার ভ্যাকসিন শুধু নিউমোনিয়ার বিরুদ্ধেই কার্যকর। এগুলো নতুন করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষা দেবে না। এই ভাইরাস একেবারেই নতুন এবং আগেরগুলোর চেয়ে আলাদা তাই এর প্রতিরোধে একেবারে নতুন ভ্যাকসিনেরই প্রয়োজন। বিভিন্ন দেশের গবেষকেরা করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা করছেন, যেখানে সহায়তা দিচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বিদ্যমান ভ্যাকসিনগুলো কোভিড-১৯–এর বিরুদ্ধে কার্যকর না হলেও শ্বাসযন্ত্রের অসুস্থতা রোধে বিদ্যমান ভ্যাকসিন যেকোনো মানুষেরই গ্রহণের পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা।

ভুল তথ্য: স্যালাইনের পানি দিয়ে নাক পরিষ্কার করলে করোনাভাইরাসের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।

সঠিক তথ্য: না। লবণ-পানি বা স্যালাইন দিয়ে নিয়মিত নাক পরিষ্কার করে নতুন করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষিত থাকা যায়—এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাধারণ ঠান্ডাজনিত অসুস্থতায় এ কৌশল কাজে লাগে। শ্বাসপ্রশ্বাসের কোনো সমস্যার ক্ষেত্রে এটি কার্যকর নয়।

ভুল তথ্য: রসুন খেলে করোনাভাইরাসের আক্রমণ ঠেকানো যায়।

সঠিক তথ্য: রসুন স্বাস্থ্যকর খাবার এবং এর রয়েছে অণুজীবনাশক ক্ষমতা। একইভাবে থানকুনি বা তুলসীপাতার স্বাস্থ্যকর এবং এগুলোর নানা ঔষধি গুণ রয়েছে। কিন্তু এর কোনোটিরই করোনাপ্রতিরোধী কোনো ক্ষমতা নেই। এমন কোনো প্রমাণ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

ভুল তথ্য: করোনাভাইরাস শুধু বয়স্কদের আক্রমণ করে।

সঠিক তথ্য: নতুন করোনাভাইরাস সব বয়সী মানুষকে আক্রান্ত করতে পারে। বয়স্ক মানুষ বিশেষত যাদের অ্যাজমা, ডায়াবেটিস, হৃদ্‌রোগসহ নানা স্বাস্থ্য সমস্যা আগে থেকেই রয়েছে, তাদের ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে গুরুতর অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি বেশি। সব বয়সী ব্যক্তিদের সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এ ক্ষেত্রে নিয়মিত হাত ধোয়া ও হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার মেনে চলার ওপর জোর দিচ্ছে সংস্থাটি।

ভুল তথ্য: নতুন করোনাভাইরাস প্রতিরোধ এবং এর চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকর

সঠিক তথ্য: অ্যান্টিবায়োটিক ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করে না। এটি শুধু ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করে। নতুন করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ একটি ভাইরাস। তাই এর প্রতিরোধ বা চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা উচিত নয়। তবে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি অনেক রোগীকে হয়তো অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, সেগুলো করোনাভাইরাসের চিকিৎসার জন্য নয়, বরং ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ যেন না ঘটে, সেজন্য দেওয়া হচ্ছে।

নতুন করোনাভাইরাস প্রতিরোধে বা এর চিকিৎসায় কি কোনো সুনির্দিষ্ট ওষুধ আছে?

সঠিক তথ্য: নতুন করোনাভাইরাস প্রতিরোধে বা এর চিকিৎসায় এখন পর্যন্ত কোনো সুনির্দিষ্ট ওষুধ নেই। তবে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে প্রকাশিত বিভিন্ন উপসর্গ অনুযায়ী তাকে চিকিৎসাসেবা দিতে হবে। যাদের অবস্থা গুরুতর হবে, তাদের বিশেষ পরিচর্যার আওতায় নিতে হবে। এর ভ্যাকসিন ও চিকিৎসার জন্য সুনির্দিষ্ট ওষুধ তৈরিতে গবেষণা চলছে। এ–সম্পর্কিত গবেষণার গতি বাড়াতে বিভিন্ন দেশে কাজ করে চলা গবেষক ও সংস্থাগুলোকে সহায়তা দিচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

তথ্যসূত্র: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)

Related posts

Leave a Comment