বুকে জ্বালাপোড়া বা এসিড রিফ্লাক্স কি? এর কারন এবং প্রতিরোধে যা করবেন

বুকজ্বালা (Heartburn) বা গ্যাস্ট্রোইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ (GERD) হলো বুকের মাঝখানে বা পেটের মাঝ বরাবর উপরের দিকে জ্বালার অনুভূতি বা ব্যথা, যা প্রথমে বুকে আরম্ভ হয় এবং পর্যায়ক্রমে ঘাড়, গলা কিংবা থুতনিতে পৌছে যায়। একে ইংলিশে হার্টবার্ণ বলা হলেও বাস্তবে এর সাথে হার্ট বা হৃদপিন্ডের কোন সম্পর্ক নেই। পাকস্থলির এসিড এই সমস্যার প্রধান কারন। সাধারনত পাকস্থলীতে অবস্থিত খাদ্য এবং অন্যান্য পদার্থের বিপরীতমুখী প্রবাহ অর্থাৎ খাদ্যনালীর দিকে ফিরে আসাকেই গ্যাস্ট্রোইসোফিজিয়াল রিফ্লাক্স বলে। বুকজ্বালা রোগটি রিফ্লাক্স, GERD বা গ্যাস্ট্রইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ, গ্যাস্ট্রিক রিফ্লাক্স ডিজিজ এবং এসিড রিফ্লাক্স ডিজিজ নামেও পরিচিত।

লক্ষণ:

  • বুকে জ্বালাপোড়া হয়। এই অনুভূতি অনেক সময়ই বুক থেকে গলা পর্যন্ত উঠে যেতে পারে। এর ফলে মুখে টক স্বাদ পাওয়া যায়। 
  • কোনো কিছু গিলতে সমস্যা হয়। এমনকি ঢোক গেলার কাজও কষ্টকর হয়ে ওঠে। এ অবস্থাকে বলে ডিসফাজিয়া। 
  • বুকে ব্যথা হয়। 
  • গলায় ব্যথা হতে পারে। মনে হয় গলায় কোনো মাংসপিণ্ড আটকে রয়েছে। 
  • শুকনো কাশি হয়। 
  • টক বমিও হতে পারে।

এ ধরনের লক্ষণ আপনার মধ্যে প্রকাশ পেলে ধরে নিতে পারেন আপনার এসিড রিফ্লাক্সের সমস্যা রয়েছে। অনেক কারণেই মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়।

কেন হয়?

আমাদের গ্রহন করা খাবার খাদ্যনালীর মাধ্যমে পাকস্থলীতে প্রবেশ করে। যে এসিড আমাদের পাকস্থলীতে খাদ্য হজম করতে সাহায্য করে, সেটা খুব শক্তিশালী। আমাদের পাকস্থলী এটা সহ্য করতে পারে। তবে খাদ্যনালীর এটা সহ্য করতে কষ্ট হয়। এই এসিড সাধারণত পাকস্থলীর বাহিরে বের হয় না। খাদ্যনালীর নিচের দিকে অবস্থিত ভালভ খাবারকে উপরে উঠতে বাধা প্রদান করে। এই ভালভ সঠিকভাবে কাজ না করলে, পাকস্থলী হতে খাদ্য উপাদানগুলো খাদ্যনালীতে প্রবেশ করে এবং পাকস্থলীর অ্যাসিড খাদ্যনালীর দেয়ালের মারাত্মক ক্ষতি করে তখন বুকে জ্বালার অনুভূতি হয়।

কিছু খাবারের কারনে বুকে জ্বালাপোড়া হতে পারে যেমন

  • টমেটো এবং টমেটো ভিত্তিক খাবার
  • চকলেট
  • মদ্যপ পানীয়
  • কফি এবং অন্যান্য ক্যাফেইনযুক্ত পানীয়
  • পেঁয়াজ, রসুন এবং বেশি মসলাযুক্ত খাবার
  • চর্বিযুক্ত এবং ভাজা খাবার
  • চর্বিযুক্ত দুগ্ধজাত পণ্য
  • সাইট্রাস ফল এবং তাদের রস যেমন- কমলা ও লেবু
  • সোডা এবং অন্যান্য কার্বনেটেড পানীয়

কিছু আচরণের কারনেও বুকে জ্বালাপোড়া হতে পারে। যেমন

  • বেশি পরিমান খাবার খাওয়া
  • টাইট প্যান্ট পরা
  • খাবার খাওয়ার পরেই শোয়া

কিছু মানুষের বুকে জ্বালাপোড়ার পেছনে কতগুলো ফ্যাক্টর কাজ করে।  যেমন

  • ধূমপান
  • মানসিক যন্ত্রনা
  • বেশি ওজন বা মোটা
  • গর্ভাবস্থায়
  • GERD আছে এমন ব্যাক্তি

কিছু কিছু ওষুধের কারনেও বুকে জ্বালাপোড়া হতে পারে। যেমন

  • Tricyclic antidepressants
  • Theophylline
  • Beta-blockers
  • Calcium channel blockers
  • Dopamine
  • Progestin
  • Sedatives ইত্যাদি

জীবনযাপন পদ্ধতি পরিবর্তন করে বুকে জ্বালাপোড়া বা এসিড রিফ্লাক্স প্রতিরোধ করার উপায়:

প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাগুলির বেশিরভাগই আপনার বুকে জ্বালাপোড়ার তীব্রতা হ্রাস করতে পারে, এমনকি এটি নির্মূল করতে সহায়তা করে। প্রথমত, আপনার খাদ্য তালিকা থেকে সম্ভাব্য সমস্যাযুক্ত খাবার এবং পানীয় সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করুন। সাধারণভাবে অ্যালকোহল এবং চর্বিযুক্ত খাবার কিছু মানুষের জন্য সমস্যার কারন হতে পারে। যদি আপনার খাদ্য তালিকা থেকে সম্ভাব্য সমস্যাযুক্ত খাবার এবং পানীয় বাদ দেওয়ার পরে আপনার লক্ষণগুলি উপশম না হয় তবে খাবারের অভ্যাসগুলি নিম্নলিখিত উপায়ে পরিবর্তন করার চেষ্টা করুনঃ

  • প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে খাবার খাওয়া।
  • একবারে বেশি না খেয়ে অল্প অল্প করে খাওয়া।
  • ধীরে ধীরে খাবার খাওয়া।
  • বুকে জ্বালাপোড়া সৃষ্টি করে এমন খাদ্য এবং পানীয়(চা বা কফি) এড়িয়ে চলা।
  • ক্যাফেইনমুক্ত পানীয় পান করা।
  • খাবার খাওয়ার পর ব্যায়াম না করা।
  • রাতে ঘুমাতে যাওয়ার কমপক্ষে ২ থেকে ৩ ঘন্টা পূর্বে রাতের খাবার খওয়া।

অন্যান্য পদক্ষেপগুলো আপনার বুকে জ্বালাপোড়া উপশমে সাহায্য করতে পারে। যেমন-

  • ওজন বেশি হলে শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা।
  • ধূমপান বর্জন করা।
  • আলগা, আরামদায়ক পোশাক পরিধান করা।
  • ঘুমানোর সময় প্রয়োজন অনুসারে কমপক্ষে ৪ থেকে ৬ ইঞ্চি বালিশ ব্যবহার করা।
  • ধ্যান, যোগ বা গভীর শ্বাস প্রশ্বাস এর মাধ্যমে মানসিক যন্ত্রনা উপশম করার চেষ্টা করা।

ওভার-দ্য-কাউন্টার ড্রাগস বা প্রেসক্রিপশন ঔষধের মাধ্যমে বুকে জ্বালাপোড়া বা এসিড রিফ্লাক্স প্রতিরোধ:

উপরের পরামর্শগুলো পালনের পরেও যদি আপনার বুকে জ্বালাপোড়ার সমস্যা না যায়, তাহলে আপনি ওভার দ্য কাউন্টার বা প্রেসক্রিপশন ঔষধ বিবেচনা করতে পারেন। তবে মনে রাখবেন, যেটা আপনার কাছে এসিড রিফ্লাক্স মনে হচ্ছে, সেটা অন্য কিছুও হতে পারে। তাই কোন ঔষধ খাওয়ার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন।

এন্টাসিড এসিড রিফ্লাক্স দ্রুত ভালো করার জন্য সবচেয়ে পুরোনো এবং পরিচিত ঔষধ। কমদামী, দ্রুত কাজ করে এবং ঠিকমতো ব্যবহার করলে অধিকাংশ মানুষের জন্য অত্যন্ত নিরাপদ হওয়ার কারণে এটা অত্যন্ত জনপ্রিয়। প্রচলিত ওভার-দ্য-কাউন্টার এন্ট্যাসিডগুলির মধ্যে রয়েছে: Entacyd® Plus (Aluminium Hydroxide, Magnesium Hydroxide, Simethicone)

যদি আপনার হার্টের কিংবা কিডনির কোনো সমস্যা থাকে তাহলে এন্টাসিড খাওয়ার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন।

যদি এন্টাসিড গ্রহণ করার পরে আপনার বুকে জ্বালাপোড়ার সমস্যা না যায়, অথবা যদি আপনি দীর্ঘস্থায়ী উপশম পেতে চান হয় তবে ওভার-দ্য-কাউন্টার এইচ 2 ব্লকার বিবেচনা করতে পারেন যা পাকস্থলীর এসিড উৎপাদন কমিয়ে দেয়। এই ওষুধের মধ্যে রয়েছে: Neotack (Ranitidine)

যদি এন্টাসিড এবং এইচ 2 ব্লকারে আপনার সমস্যা সমাধান না হয় কিংবা এসিড রিফ্লাক্স যদি ঘনঘন এবং তীব্র আকারে দেখা দেয়, তাহলে আপনি proton pump inhibitor (PPI) বিবেচনা করতে পারেন । এই ওষুধের মধ্যে রয়েছে: Nexium (Esomeprazole)

খালি পেটে খেলে PPI সবচেয়ে ভালো কাজ করে। তাই সকালে নাস্তা খাওয়ার ৩০-৬০ মিনিট আগে এটা খাওয়া সবচেয়ে উত্তম।

পরিশেষে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবন করবেন না।

[প্রিয় পাঠক, আপনি যদি হেলথকেয়ার প্রফেশনাল হন তাহলে স্বাস্থ্যসেবা.কম এ লিখতে পারেন। রোগ লক্ষন ও প্রতিকার, ওষুধ, খাবারের গুনাগুন ও স্বাস্থ্য সম্পর্কিত লাইফস্টাইল নিয়ে লিখুন এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ছবিসহ ই-মেইল করুন- write@shasthoseba.com -এ ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।]

ইউটিউব সাবস্ক্রাইব করুন  

Related posts

Leave a Comment