প্রকৃতির নিয়মেই বয়ো:বৃদ্ধির সাথে সাথে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে বিভিন্ন রোগ দেখা দেয় । হাড় ও জোড়া এর থেকে ব্যতিক্রম নয় । বয়ো:বৃদ্ধির সাথে হাড় ও জোড়ায় বিভিন্ন রোগের উপসর্গ দেখা দেয় । মানব শরীরে ২০৬ টি হাড়ের সমন্বয়ে ১৪৭ টি ছোট বড় জোড়া ক্সতরী হয় । হাড় ও জোড়ার বিভিন্ন রোগের কারণে বয়োবৃদ্বিকালে মানুষ অধিকতর কাবু হয় এবং যন্ত্রনায় হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে । পুরুষের তুলনায় মহিলারা কিছুটা আগে ভাগেই হাড় ও জোড়ার সমস্যায় আক্রান্ত হয় । পুরুষরা সাধারনত ৪০ বৎসর এবং মহিলারা ৩৫ বৎসর বয়সে হাড় ও জোড়ার রোগে ভোগে । বংশানুক্রমিক, শারীরিকগঠন, পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও অন্যান্য রোগের জন্য সমস্যা আগে পরে শুরু হতে পারে এবং রোগের তীব্রতা বিভিন্ন রকম হতে পারে । কিছু কিছু হাড়ের টিউমার বয়ো:বৃদ্ধি কালে হয় কিন্তু অল্পবয়সে হয় না । সাধারনত দেখা যায়, হাড়ের ক্ষয় ও ভঙ্গুরতা এবং জোড়ার আর্থ্রাইটিসে বয়স্করা আক্রান্ত হয় সব চেয়ে বেশী । শরীরের সব জোড়াতেই বয়সজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে । তবে মেরুদন্ডের জোড়া, কাঁধ, হাঁটু ও কটির জোড়ায় বেশী সমস্যা হয় ।
বয়ো:বৃদ্ধিকালে হাড় ও জোড়ার সমস্যার কারণ কি ?
১. যথোপোযুক্ত সুষম খাদ্য, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি এর অভাব ।
২. খাদ্যনালীর বিভিন্ন রোগের কারণে খাদ্য শরীরে প্রবেশ না করলে ।
৩. বৃক্কের (কিডনি) সমস্যার কারনে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি শরীর থেকে বের হয়ে গেলে ।
৪. ক্যান্সার কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি ।
৫. শারীরিকগঠন ও কায়িক পরিশ্রম ।
৬. গ্রন্থির সমস্যায় হরমোনের তারতম্যের কারণে হাড় ও জোড়া বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয় ।
৭. এছাড়া ব্যবহার জনিত ক্ষয়ে পেশী, জোড়ার আবরন, লিগামেন্ট, জোড়ার হাড় ও তরুনাস্থি আক্রান্ত হয় ।
রোগের উপসর্গ:
১. হাড়ে ব্যথা ও ভঙ্গুরতা
ঘাড় ও কোমরের হাড় (কশেরুকা), কবজি (রিস্ট) এবং কটির জোড়ার কাছের হাড়ে ব্যথা হয়, নরম হয় এবং অল্প আঘাতেই ভেঙ্গে যায় । এর জন্য ঘাড়. বাহু, হাত, কোমর, লেগ ও পায়ে ব্যথা হয় এবং দুর্বলতা ও অবশ ভাব হতে পারে ।
২. কাঁধের সমস্যা
– ব্যথা ।
– উক্ত কাঁধে কাত হয়ে ঘুমানো যায় না।
– হাত সামনে বা পাশে উঠাতে কষ্ট হয় ।
– হাত দিয়ে জামার বোতাম লাগানো যায় না ।
– মাথার চুল আঁচড়ানো কষ্টকর ।
– প্যান্টের পিছনের পকেটে হাত দেওয়া ও পিঠ চুলকানো যায় না ।
– কখনও কখনও জোড়া ফুলে যায় ।
– কতিপয় নড়াচড়ায় জোড়া ছুটে যাবে এমন মনে হয় ।
৩. হাঁটুর জোড়ার সমস্যা
– ফুলা ও ব্যথার জন্য হাঁটুর নড়াচড়া করা যায় না ।
– নড়াচড়ার সময় ক্র্যাকিং (ক্রিপিটাস) শব্দ শুনতে বা বুঝতে পারা যাবে।
– রোগী বেশীক্ষন বসলে হাঁটু সোজা করতে কষ্ট হয় ।
– অনেক সময় হাঁটু আটকিয়ে যায়, রোগী হাঁটুকে বিভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে সোজা করে ।
– হাঁটুর পেশী শুকিয়ে যায় এবং হাঁটুতে শক্তি কমে যায় ।
– উঁচু নিচু জায়গায় হাঁটা যায় না , সিঁড়ি দিয়ে উঠা নামা করতে এবং বসলে উঠতে কষ্ট হয় ।
– হাঁটু অস্থিতিশীল হবে -দাঁড়াতে বা হাটতে চেষ্টা করলে মনে হবে হাঁটু ছুটে যাচ্ছে বা বেঁকে যাচ্ছে ।
৪. কটির জোড়ার সমস্যা:
– কুঁচকি, নিতম্ব, উরুর ভিতর পাশে এবং হাঁটুতে ব্যথা হয় ।
– জোড়া জমে যাওয়ার জন্য পায়ে মোজা পরতে অসুবিধা হয় ।
– বিভিন্ন নড়াচড়া সীমিত হয় ।
– খুঁড়িয়ে হাঁটতে হয় ।
– রাতে এবং বিশ্রামে ব্যথা হলে বুঝতে হবে রোগ গুরুতর ।
প্রতিকার বা চিকিৎসা:
বার্ধক্যজনিত হাড় ও জোড়ার সমস্যা থেকে সম্পূর্ন নিরাময় হওয়া যায় না। কিন্তু বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা এবং দৈনন্দিন জীবন ব্যবস্থা পরিবর্তনের মাধ্যমে রোগের তীব্রতা থেকে উপশম পাওয়া সম্ভব। প্রাথমিকভাবে ব্যথা ও অস্বস্থিকর অবস্থা দূর করতে হবে, জোড়ার জমাট অবস্থা ভালো করতে হবে এবং জোড়াকে অতিরিক্ত ক্ষতি হতে রক্ষা করতে হবে। তবে চিকিৎসা প্রদানের পূর্বে রোগীকে ভালোভাবে শারীরিক পরীক্ষা করা এবং প্রয়োজনীয় ল্যাবরেটরী পরীক্ষা – নিরীক্ষা করা একান্ত প্রয়োজন ।
১। অতিরিক্ত ওজন কমাতে হবে। ফল, শাকসবজি, কম ক্যালোরী, কম সুগার ও কম চর্বি যুক্ত খাবার, শিম, মটরশুঁটি, চর্বিবিহীন মাংশ, বাদাম ও অক্ষত খাদ্যশস্য ইত্যাদি খেতে হবে ।
২। প্রয়োজনে জোড়ার উপর চাপ কমানোর জন্য হাতে ওয়াকিং স্টিক, উঁচু চেয়ারে বসা, ব্রেচ বা হাঁটু সাপোর্ট ও কুশন যুক্ত জুতা ব্যবহার করলে কোমর, কটি ও হাঁটুর ব্যথা কম হবে ।
৩। জোড়ায় স্বাভাবিক নড়াচড়া ও পেশী শক্তিশালী হওয়ার ব্যায়ামে জোড়া জমে যাওয়া লাঘব করে । এছাড়া অন্যান্য ব্যায়াম যেমন নিয়মিত হাটা, জগিং ও ওজন বহন করা ইত্যাদি করতে হবে। কায়িক পরিশ্রম করলে হাড়ের পরিমান বেড়ে যায় এবং হাড় মোটা হয় । জোড়ার চারি পাশের পেশী ও টিস্যু সংকুচিত হলে স্বাভাবিক নড়াচড়া পুন:রুদ্বার করা বড়ই কঠিন ।
৪। সিঁড়ি দিয়ে উঠানামা কম করতে হবে।
৫। বেশীক্ষণ বসে থাকা যাবে না।
৬। সমতল জায়গায় হাঁটা হাঁটি করতে হবে।
৭। বেদনানাশক ঔষুধ সেবন করতে হবে
৮। গ্লুকোসামাইন, ক্যাসারিন, কনড্রিওটিন সালফেট ঔষধ সেবনে তরুনাস্থি ক্ষয় নিবারণে উপকার পাওয়া যেতে পারে ।
৯। দৈনিক সুষম খাদ্য, ভিটামিন সি, ডি, ও ক্যালসিয়াম নিয়মিত সেবনে রোগের তীব্রতা কমে আসবে ।
১০। ইন্ট্রাআর্টিকুলার করটিকোস্টেরয়েড ইনজেকশন সীমিত সময়ের জন্য ব্যথা মুক্ত করে। ইনজেকশন এক বৎসরে তিন বা চারের অধিকবার দেওয়া নিষেধ ।
১১। হায়ালুরোনিক এসিড জোড়ায় পুশ করলে রোগের উপসর্গ উপশম হবে । সপ্তাহে্ একবার করে পাঁচ সপ্তাহে পাঁচটি ইনজেকশন পুশ করত হবে ।
১২। ফিজিকেল থেরাপি – রেডিয়ান্ট হিট বা এস, ডব্লিউ, ডি, ও ইউ,এস, টি ব্যবহারে উপকার পাওয়া যেতে পারে।
১৩। নি ক্যাপ বা ইলাষ্টিক সাপোর্ট ব্যবহার করলে জোড়ায় ভারসাম্য রক্ষা হবে।
১৪। গরম ও ঠান্ডা সেঁক ব্যবহারে পেশীর সংকোচন কমবে, রক্ত চলাচল বাড়বে এবং ব্যথা কমবে ।
১৫। ধুমপান ও মদপান থেকে বিরত থাকা বাঞ্ছনীয়।
কখন সার্জিকেল চিকিৎসার প্রয়োজন?
নিম্নের কারনে শল্য চিকিৎসার প্রয়োজন হয়:-
১ । ব্যথা নিরাময় না হলে ।
২ । স্বাভাবিক নড়াচড়া জোড়ায় কম হলে ।
৩ । জোড়া আটকিয়ে (লকিং) গেলে ।
৪ । জোড়া অস্থিতিশীল হলে বা ছুটে বা ঘুরে যাবে এমন মনে হলে ।
৫ । জোড়া বিকৃত হলে ।
৬ । পেশী শুকিয়ে জোড়া দুর্বল হলে ।
৭ । জোড়া স্থানচ্যুতি হলে এবং হাড় ভাঙ্গলে ।
আর্থ্রোস্কোপিক চিকিৎসা ব্যবস্থা:
আর্থ্রোস্কোপিক সার্জিকেল চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ভর করে হাড় ও জোড়ার সমস্যার কারণ সমূহের উপর। বর্তমানে অর্থোপেডিক চিকিৎসায় সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ”আর্থ্রোস্কোপ” ছোট ছিদ্রের মাধ্যমে জোড়ায় প্রবেশ করিয়ে –
১. জোড়ার অতিরিক্ত হাড়, বিচ্ছিন্ন হাড় ও তরুনাস্থির টুকরা অংশ বের করা হয় ।
২. জোড়ার অতিরিক্ত টিস্যু (সাইনোভিয়াম) কেটে বের করা হয় ।
৩. জোড়ার হাড় ও তরুনাস্থির সেভিং করে হাড়ে মাইক্রো পাংচার করা হয় ।
৪. মেনিসকাস সেলাই ও সেভিং করা হয় ।
৫. জোড়ার আবরন ও জোড়ার পেশী সেলাই করা হয় ।
৬. ল্যাবরাম ও জোড়ার আবরন সেলাই করে জোড়ার স্থানচ্যুতির প্রবনতা রোধ করা যায় ।
৭. লিগামেন্ট তৈরী করা হয় ।
৮. জমাট জোড়ায় নড়াচড়া ফিরিয়ে আনা হয় ।
সার্জিকেল চিকিৎসা:
১. জোড়ার বিকৃত অবস্থার জন্য সংশোধনী ওসটিওটোমি (হাড় কাটা) করা হয় ।
২. অতিরিক্ত ক্ষতির জন্য জোড়া পুন:স্থাপন করা হয় ।
লেখক: ডা: জি. এম. জাহাঙ্গীর হোসেন, সহকারী অধ্যাপক, অর্থোপেডিক সার্জারী বিভাগ, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পূনর্বাসন প্রতিষ্ঠান(নিটোর), ঢাকা
[প্রিয় পাঠক, আপনি যদি হেলথকেয়ার প্রফেশনাল হন তাহলে স্বাস্থ্যসেবা.কম এ লিখতে পারেন। রোগ লক্ষন ও প্রতিকার, ওষুধ, খাবারের গুনাগুন ও স্বাস্থ্য সম্পর্কিত লাইফস্টাইল নিয়ে লিখুন এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ছবিসহ ই-মেইল করুন- write@shasthoseba.com -এ ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।]